মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা আর হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা - এ দুই স্থানে অবস্থিত ২ টি জাতীয় উদ্যান বা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এদের অবস্থান সিলেট বিভাগে যা - বাংলাদেশের চায়ের রাজধানী হিসাবে সুপরিচিত। পাহাড়ের ঢালে চা বাগানের অপূর্ব দৃশ্য ছাড়াও এর আশেপাশে রয়েছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রাবার বাগান, সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা, মাধবপুর লেক সহ আরো বেশকিছু দর্শনীয় স্থান।
ঢাকা থেকে সড়ক এবং রেলপথে সরাসরি যাওয়া সম্ভব। উভয় পথেই সময় লাগে প্রায় ৫ ঘন্টা। এ রুটে হানিফ পরিবহন, এনা পরিবহন, শ্যামলী পরিবহনসহ বেশ কিছু অপারেটরের বাস চলাচল করে। বাসগুলো সায়েদাবাদ এবং ফকিরাপুর থেকে ছেড়ে যায়। অন্যদিকে পারাবত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেস এবং উপবন এক্সপ্রেস নামক ট্রেনগুলো সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
বছরের পর বছর যায়, তবু এ স্থানের জনপ্রিয়তা বাড়ে বৈ কমে না। সেই কবে 'অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইস' এর ফিলিয়াস ফগ এসে পৌঁছেছিলেন লাউয়াছড়ার অভ্যন্তরের রেলপথে, আজও লোকে সেখানে বেড়াতে যায়। প্রায় সারা বছরই এখানে পর্যটকদের ভীড় লেগে থাকে। বিরল প্রজাতির পাখি, বাঁদর, হরিণ প্রভৃতি প্রাণীদের বাসস্থান এই উদ্যান। এদেরকে এক নজর দেখার পাশাপাশি হাইকিং ও ট্রেকিংয়ের জন্যও এ বন বেশ উপযোগী। তবে সেসময় স্থানীয় একজন গাইড সঙ্গে রাখলে ভালো হয়।
শীতকালে শিশিরের অন্য এক জাদু ছড়িয়ে পড়ে এই রেইনফরেস্টে। হালকা কাদামাখা পথ দিয়ে একা একা হেঁটে যেতেও মন ছুঁয়ে যাবে প্রশান্তি। নাগরিক কোলাহল এড়িয়ে কিছুক্ষণের এই নির্জনতা সঙ্গী হবে হয়তো কাছেই ডেকে ওঠা একটা পাখির। প্রকৃতি ধরা দেবে চোখের সীমানায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান মৌলভীবাজার শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং বাস বা ট্রেনের মাধ্যমে এখানে যাওয়া সম্ভব।
মাধবপুর লেক
কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর চা বাগানের অভ্যন্তরে অবস্থিত এই লেকটি। জলপদ্মসহ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদে পরিপূর্ণ এই স্থানটিতে বহু ধরনের পাখিদেরও আনাগোনা রয়েছে। একেক ঋতুতে মাধবপুর লেকের যেন একেক রূপ। কারও চোখে হয়তোবা তা ধরা দিতে পারে জল-উপকথার বিচিত্র প্রাণীর আকৃতিতে।
শীতকালে মাধবপুর লেকের মোহনীয় চেহারা ধরা দেয় পর্যটকদের কাছে। এ সময়ে সাদা পেটের বগলা পাখিও দেখা যায়। শ্রীমঙ্গল থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলেই স্বপ্নালু এই হ্রদের দেখা মিলবে।
নীলকণ্ঠ টি-কেবিনের বিখ্যাত সাত রং চা
শুরুরদিকে শুধু একজায়গায় থাকলেও এখন বেশকিছু যায়গায় রয়েছে এই সাত রং চা এর উপস্থিতি, তবে মূল সাতরঙা চা বলতে নীলকন্ঠ কেবিনের চা কেই বোঝানো হয়। শ্রীমঙ্গলে বধ্যভূমি, বিডিআর ক্যাম্প ও কালীঘাট এই তিন যায়গায় নীলকণ্ঠ চা কেবিন আছে তিনটি। সিলেটের গন্ডি ছাড়িয়ে এখন রাজধানীর ঢাকার অন্যতম ব্যাস্ত এলাকা খিলগাও এর তালতলাতেও এই সাত রঙের চা পাওয়া যায়। চায়ের লম্বা গ্লাসে এক স্তরের ওপর ভেসে থাকে আরেক স্তর। প্রতিটি স্তরে ভিন্ন রঙ। ঠিক এক গ্লাসে সাত রঙের সাত স্বাদের চা। প্রতিটা রঙ ভিন্ন। একটি অপরটির সঙ্গে মিশে না। প্রতিটা রঙের স্বাদও আলাদা। এর স্বাদ নিয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক রয়েছে তবে স্বাদ যতটা না ভাল তারচেয়েও ভাল হচ্ছে এর সৌন্দর্যটা । সাত রঙের চা বলে খ্যাত হলেও বর্তমানে চা পাবেন আট রঙের। তবে আট রঙ বলালে আসলে ভুল হয়ে যায় আটটি ভিন্ন স্তরের চা। রঙ থাকে ২/৩টি। বিভিন্ন ধরণের মসলার ব্যবহারের তারতম্য, পানির ঘনত্বের চমৎকার বিন্যাস চায়ের এই স্তর সৃষ্টি করে।
সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা
সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা (Shitesh Babu’s Zoo) মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার একটি সমৃদ্ধ ও একমাত্র চিড়িয়াখানা (যেটি বর্তমানে বন্য প্রানী সেবা ফাউন্ডেশন)। চিড়িয়াখানটি শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে হাইল হাওরের কাছে অবস্থিত। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ১ কি.মি পশ্চিমে একশত আশি একর জায়গাজুড়ে সিতেশ বাবুর গড়ে তুলেন। বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন নগরী শ্রীমঙ্গলে এই চিড়িয়াখানাটি স্থাপিত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটকসহ বিদেশি অনেক পর্যটকও প্রতিদিন ভিড় করেন এ চিড়িয়াখানায়। অত্র এলাকার মানুষের শিক্ষার সহায়ক একটি ক্ষেত্রও বলা যায় এই চিড়িয়াখানাকে।
সিতেশ বাবুর পরিবার দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রাণি সংগ্রহের পর বর্তমানে এটি একটি পরিপূর্ণ চিড়িয়াখানায় পরিণত হয়েছে। চিড়িয়াখানায় সংরক্ষিত বিভিন্ন ধরনের জীব জন্তুর মধ্যে রয়েছে: দেশের একমাত্র বিলুপ্ত প্রায় সাদা বাঘ, বিরল প্রজাতির সোনালী বাঘ, হিংস্র মেছোবাঘ, সোনালী হনুমান, সজারু, চারপাশে আতপ চালে গন্ধ ছড়ানো গন্ধগোকুল,নিশি বক, পাহাড়ি বক, সোনালী কচ্ছপ, বন মোরগ, ডাহুক, জংলী রাজহাস, সবুজ ঘুঘু, ধনেশ, তিলা ঘুঘু, রাজ সরলী, চা পাখি, অজগর, তোতা,ময়না, কচ্চপ, ভল্লুক ও অসংখ্য বিরল প্রজাতির প্রাণী।
এছাড়াও আছে লজ্জাবতী বানর, লাল উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, হনুমান, মায়া হরিণসহ প্রায় দেড়শ প্রজাতির জীবজন্তু। রয়েছে কালো-হলুদ ডোরাকাটা ত্রিভুজাকৃতির বিলুপ্তপ্রায় শঙ্খিনীণি, আছে হিমালয়ান সিভিটকেট, সোনালি কচুয়া, বন্য খরগোশ,মথুরা, বন্য রাজহাঁস, লেঞ্জা, ধলা বালিহাঁস, প্যারিহাঁস,চিত্রা হরিণ, কোয়েল, লাভবার্ড, কাসে-চড়া,বনরুই, বিভিন্ন রঙের খরগোশ, সোনালি খাটাশ, বড় গুইসাপ, ধনেশ, হিমালয়ান টিয়া, ময়না, ময়ূর, কালিম, বাজিরিক, শঙ্খ চিল, হরিয়াল প্রভৃতিও।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের একটি প্রাকৃতিক উদ্যান। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ/সংশোধন আইনের বলে ২৪৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে “সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান”(Satchari Jatio Uddan) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই উদ্যানে সাতটি পাহাড়ি ছড়া আছে, সেই থেকে এর নামকরণ সাতছড়ি (অর্থ: সাতটি ছড়াবিশিষ্ট)। সাতছড়ির আগের নাম ছিলো “রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্ট”।
জাতীয় উদ্যানটি কয়েকটি চা বাগান, গ্রাম, শহর এবং চাষাবাদকৃত জমি দ্বারা নিবিড়ভাবে বেষ্টিত। সাতছড়ি উদ্যানের কাছাকাছি ৯টি চা বাগান অবস্থিত। উদ্যানের পশ্চিম দিকে সাতছড়ি চা বাগান এবং পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা বাগান অবস্থিত। টিপরাপাড়া নামে একটি গ্রাম উদ্যানটির ভেতরে অবস্থিত। যেখানে ২৪টি আদিবাসী উপজাতি পরিবার বসবাস করে। আশপাশের চৌদ্দটি গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে চা বাগানের শ্রমিক ও বনের মধ্যে বসবাসকারীরা বিভিন্নভাবে বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে ১৪৫ প্রজাতির গাছপালা ছাড়াও ১৯৭ প্রজাতির জীব। যার মধ্যে ১৪৯ প্রজাতির পাখি, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৬ প্রজাতির উভচর প্রাণী। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের উল্লুকগুলোর এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফালাফি এবং পোকামাকড়ের বিচিত্র ধরনের ঝিঁঝিঁ শব্দ পর্যটকদের মধ্যে দারুণ আনন্দ দেয়।
এ বনের ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে উল্লুক, মেছোবাঘ, শুকুর, সাপ, মুখপোড়া হনুমান, চশমা হনুমান, লজ্জাবতী বানর, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ১৪৯ প্রজাতির পাখির মধ্যে ধনেশ, লাল মাথা ট্রগন এবং বিরল উদ্ভিদের মধ্যে বিষলতা, পিতরাজ, কানাইডিঙ্গা, আগর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ২০ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হতে চলছে। বিলুপ্ত প্রায় এসব প্রজাতির মধ্যে রয়েছে চিতা বাঘ, মেছো বাঘ, লজ্জাবতি বানর, মায়া হরিণ, উল্লুক, ময়না পাখি, ঘুঘু পাখি, টিয়া পাখি, ঈগল পাখিসহ উল্লেখযোগ্য বন্যপ্রাণী কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে।
কালারডুবা হাওড় / নৌকা ঘাট
স্নিগ্ধ বাতাসে বিস্তীর্ণ হাওড়ের বিশাল জলরাশির পাশে প্রিয়জনদের সঙ্গে বেড়াতে হাজারো মানুষের ভিড় করছেন হবিগঞ্জের কালারডুবা হাওরের পাড়ে। বর্ষা মৌসুমের পড়ন্ত বিকেলে দর্শনার্থীদের আগ্রহ একটু বেশি। তবে, এ স্থানে একটি পরিকল্পিত বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের। কেউ চড়েছেন নৌকায়, কেউবা পাড়ে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন। পড়ন্ত বিকেলে দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখর কালারডুবা হাওড় এলাকা। বর্ষা মৌসুমে হবিগঞ্জের সদর উপজেলার কালারডুবা হাওড় এলাকায় এমনই ভিড় লেগে থাকে। জেলা শহরের কাছাকাছি কোন বিনোদনকেন্দ্র না থাকায় বিকেলে হাজারো মানুষ জড়ো হন হাওড়পাড়ে। দর্শনার্থীদের বসে খাওয়ার জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট ঘর। পানি ভেসে বেড়ানোর জন্য রয়েছে নৌকা।
আজ এ পর্যন্তই, সবাই পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখবেন। সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ !