Showing posts with label অসমাপ্ত. Show all posts
Showing posts with label অসমাপ্ত. Show all posts

Wednesday, April 1, 2020

অসমাপ্ত ( ৭ম পর্ব )

বিদায় বেলায় দুজনেরই হয়ত কিছু বলার ছিল তবে কেন যেন কেউই কিছু বলতে পারছিলাম না। বিচ্ছেদের এই সময়টা যে আসবে সে তো আমাদের জানাই ছিল। মাতৃভাষায় এত লক্ষ সহস্রাধিক শব্দ থাকা সত্ত্বেও মনের কথাটি বলার জন্য উপযুক্ত কোন শব্দ কেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না? রবীন্দ্রনাথের মত ভাষা আমার নেই, থাকলে হয়ত বলতে পারতাম -

``যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।"

বেশ কিছুক্ষন ইতস্ততঃ করার পর সে বলে উঠল - ``কিছু বলবে?" কি বলব আমি? কিভাবে তাকে বুঝাব যে আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ? আমি শুধু  তাকিয়ে রইলাম। কেন যেন আমার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না ওর। কথাটি বলার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা বলতে চাইছিল। কোন এক অজানা কারণে কথাটি তার কণ্ঠ থেকে মুখ অবধি পৌঁছাতে পারছিলো না। চারিদিকে মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। সবাই ব্যাস্ত, ছুটে চলেছে আপন কর্মক্ষেত্রে। আমরা দুটি নিশ্চল প্রাণী সেখানে বেমানান।

হঠাৎ কোন কিছু না বলেই ঘুরে চলতে শুরু করল অধরা। আমি তখনও অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, এতক্ষনে আমার চেতনা ফিরে আসল। তাকে যে অনেক কথা বলার ছিল, কি বলব তাকে আমি? আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? ভালবাসি?

জীবন নদীতে স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বাইতে বাইতে আজ আমি ক্লান্ত। মনে হচ্ছিল হাল ধরার দায়িত্বটা কাউকে দেয়া উচিৎ। এতটা অসহায় আর কখনো মনে হয়নি, এতটা ক্লান্তিও আর কখনো অনুভব করিনি। তবে কি সত্যিই তাকে ভালবেসে ফেলেছি? নাহ ! আমার মত একজন আত্মসচেতন আর চেতনাবোধ সম্পন্ন ছেলের পক্ষে এরকম চিন্তা করাটা একদমই অনুচিত।

যদি বলি ভালবাসি তবে মিথ্যা বলা হবে। কেননা `Love at first sight' এ আমি বিশ্বাস করি না, বরং সেটা `Lust at first sight' হতে পারে। প্রথম দেখায় কাউকে ভাল লাগতেই পারে তবে ভালবাসা এতটা সস্তা নয়। ভালবাসা অমূল্য, শুধুমাত্র চোখের জলে তার মূল্য দেয়ার চেষ্টা করাটাও বৃথা। আপনি যদি কাউকে সত্যিই ভালবেসে থাকেন তবে আপনার বুকে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে তার কথা ভাবুন আর বলুন ভালবাসি। দেখবেন আপনার হৃদয় থেকেও তেমনটাই উত্তর পাবেন। তাছাড়া যার জন্য আমার দু-ফোঁটা চোখের জলও ঝড়েনি তাকে আর যাই হোক ভালবাসি বলতে পারি না।

তবে কি বলব তোমাকে অনেক ভাল লেগেছে, এতটা কম সময়ে এতটা বেশি ভাল আর কাউকে লাগেনি, এতটা কাছেও কেউ আসতে পারেনি। আরও কিছু সময় পেলে হয়ত . . . নাহ থাক ! এরকমটা বললে হয়ত ভুল কিছু ভেবে বসতে পারে অথবা এটাও ভাবতে পারে যে আমি তার প্রতি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছি। তাহলে কী বলব আমি ?

সময় পার হয়ে যাচ্ছে, ইতোমধ্যে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে অধরা। চারপাশে মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। কিছু বলতে হবে তাকে, আবার কখনো আমাদের দেখা হবে কি না? তার ফোন নাম্বার, বাসার ঠিকানা না হোক অন্তত ফেসবুক আইডিটা তো চাইতেই পারি। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, ততক্ষণে সে অনেকটাই দূরে চলে গেছে। কিভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করব? কি বলে ডাকব তাকে? আমি যে তার নামটাও জানি না। ক্রমশঃ আমাদের মাঝে দূরত্ব বেড়েই চলেছে, সে চলে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে।

কলেজ জীবন থেকেই মিউজিক করতাম, একটা ব্যান্ড ও ছিলো আমার যার গিটারিস্ট এবং ভোকালিস্টও ছিলাম। 'মহীনের ঘোড়াগুলি' - ব্যান্ডের সেই গানটি কখনো স্টেজে না গাইলেও সেই সময় সেটাই আমার বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছিলো :

``ভেবে দেখেছো কি
তারা-রাও যতো আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে ।।"

একটি বারের জন্যেও কি ফিরে তাকাবে না অধরা? দয়া করে একটি বার হলেও ফিরে তাকাও, না হয় দূর থেকেই শেষ বারের মত তোমায় দেখব। অধরা যতই দূরে চলে যাচ্ছে তাকে একটি বার অন্তত দেখার আকাঙ্খাও ততটাই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সেই সাথে তাকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কাও আমাকে ঘিরে ফেলেছিল। চিৎকার করতে চাইলেও তা পারছিলাম না, এই ভিড়ের মধ্যে কে-ই বা আমার চিৎকার শুনবে। অধরাকে শেষ বারের মত দেখার আশাটাও যখন বিসর্জন দিতে বসেছিলাম ঠিক তখনই ভাগ্যদেবতা আমার প্রতি মুচকী হাসলেন।

দূরে একটা যাত্রী ছাউনির নিচে গিয়ে অধরা দাঁড়িয়ে পড়ল আর আমি তখনও লোক-জনের ভিড়ের ঠিক কেন্দ্র বিন্দুতে। এই বার অধরা পেছনে ফিরে তাকাল, হাজারো মানুষের মাঝে তার দৃষ্টি ঠিকই আমাকে খুঁজে পেয়েছিল। আমি আর এগিয়ে চলার শক্তি পাচ্ছিলাম না, তাকে দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা হাসল সে তারপর বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া তার চুল গুলো কপালের নিচ থেকে, চোখের ঠিক পাশ দিয়ে গাল পর্যন্ত টেনে কানের পাশে সরিয়ে দিল সেই সাথে তার গোলাপি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গেলেও তার সেই নিষ্পাপ চাহনি কখনো ভুলতে পারব বলে মনে হয় না।

কোথা থেকে যেন আবার এগিয়ে চলার শক্তি সঞ্চারিত হল আমার শরীরে, হয়ত অধরার চাহনিতেই সেই শক্তি লুকায়িত ছিল। আবার ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলতে শুরু করলাম, আগের চেয়ে দ্বিগুন গতিতে। কিন্ত এইবার ভাগ্যদেবতা মুচকী নয় অট্টহাসি হাসলেন, কোথা থেকে যেন সাদা একটা প্রাইভেটকার এসে সেই যাত্রী ছাউনিটার সামনে থামল আর অধরা আমার দিকে ফিরে তার সেই ভুবনভুলানো মুক্তাঝড়া হাসি দিয়ে গাড়িটাতে উঠে পড়ল। আর তারপর বাকিটা ইতিহাস ...

সেই ইতিহাস আর লিখতে চাই না, ভেবেছিলাম এই গল্পটাও কখনো লিখব না। তবে কেন লিখলাম ? আসলে যা অসমাপ্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, থেকে যায় কিছু কথা, কিছু স্মৃতি। গল্পের শেষ কোথায় তা আমরা জানি না, কখনো তার সমাপ্তি হয়, কখনো হয় না।

সেদিনের পর থেকে আজ অবধি অধরা আর আমার কাছে ধরা দেয়নি। জানিনা, আর কখনো আমাদের দেখা হবে কি না। শুনেছিলাম, হারম্যান ভাইলের আবিষ্কারের (১৯২৯) প্রায় ৮৫ বছর পর ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞনীরা (ভাইল ফার্মিয়ন) অধরা কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। তেমনি হয়ত আমিও কোন একদিন অধরাকে খুঁজে পাব।

যদি আবার কখনও আমাদের দেখা হয়েই যায় তবে না বলা সেই কথা গুলো অবশ্যই তাকে বলব। কী বলব, কিভাবে বলব এসব নিয়ে আর চিন্তা করব না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে যা মনে আসবে বলে ফেলব। যদি আবারও ভাষা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা দেখা দেয় তবে তার পূর্বে এতটুকু অবশ্যই বলব - আমার দেখা বিধাতার সুন্দরতম সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন তুমি। দয়া করে তোমার নামটা আমায় বলবে কি ?
(সমাপ্ত )

Sunday, March 22, 2020

অসমাপ্ত ( ৬ষ্ঠ পর্ব )

বাসে দুজন পাশাপাশি বসে একে অপরের দিকে শুধু তাকিয়েই ছিলাম, মাঝে মাঝে হাসি দিয়ে সে হয়তো সম্মতি দিচ্ছিলো আমি চাইলে কিছু বলতে পারি কিন্তু কিভাবে বোঝাই আমিও যে অনেকটাই লাজুক স্বভাবের। কিছু তো বলতে পারলামই না শুধু তাকিয়েই রইলাম। তারপর একসময় সেই বলতে শুরু করলো :

- আমি আসলে অনেক একা।  মানুষের সাথে খুব একটা মিশতে পারি না। 
- এমনটা বলছো কেন ? আমি যতদূর জানি উত্তর বঙ্গের মেয়েরা বেশ মিশুক হয়। 
- হতে পারে।  তবে আমি তেমনটা নই। আসলে অনেক কষ্ট পেয়েছি মানুষের কাছ থেকে।  তাই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। 
- বুঝতে পেরেছি , তাই হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। উল্টো ভয় পাচ্ছেন। 
- ভয় কেন পাবো ? আপনি তো ভয়ংকর না, বেশ সুদর্শন আর স্মার্ট একটা ছেলে। সহজেই যে কোনো মেয়ের ক্রাশ হতে পারেন। 
- হা: হা: হা:  তাই ? আমি আসলে বলতে চাইছিলাম আপনি হয়তো আমাকে বিশ্বাস করতে ভয় পাচ্ছেন। 
- তা কিছুটা ভয় তো আছেই, আপনি অপরিচিত মানুষ তাই। 
- আসলে পরিচয় ব্যাপারটাই কি মূল বিষয় ?  আপনি, আমি বা আমরা সবাই পৃথিবীতে আসার পর তিন মাস বয়স পর্যন্ত কাউকেই চিনতে পারি না। শিশুরা প্রথমে তার মা - কেই চিনতে পারে। বড় হবার পর মা আমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। 
- আপনি তো অনেক কিছু জানেন দেখছি। 
- তেমনটা নয়, আপনি ভবিষ্যৎ ডাক্তার।  এসব তো আপনিই ভালো জানবেন। 

এর মধ্যেই বাস ফেরিতে উঠে গেছে, আর ফেরিটাও চলতে শুরু করেছে। অধরাকে বললাম সে বাইরে যাবে কি না, কেননা আমি চাচ্ছিলাম ফেরি থেকে নদীটাকে দেখতে।  নদীর মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করতে বেশ ভালো লাগতো।  আমি উঠে দাঁড়াতেই দেখি অধরাও আমার সাথে যাবার জন্য প্রস্তুত।

বাইরে বেরিয়ে ফেরির সামনের দিকটায় চলে আসলাম। একপাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। অধরাও তাকিয়ে আছে, তবে কেন যেন তাকে বেশ উদাস মনে হচ্ছিলো। কিছু জিজ্ঞাসা করবো কি না বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছিলো সে ও হয়তো কিছু বলতে চাইছে। ভাবলাম আগ বাড়িয়ে কিছু বলার থেকে অপেক্ষা করাই ভালো। এসব ভাবতে ভাবতেই পশে ফিরে দেখি অধরা নেই। কোথায় গেলো হঠাৎ করে ? আশে-পাশে খুজলাম, দেখতে পেলাম না। সে কি বাসে উঠে গেলো ? কিছু না বলে চলে কেনই বা চলে গেলো ? কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।

ভাবলাম বাসে গিয়ে দেখে আসি, আবার ভাবলাম ফিরে গিয়ে কি বলবো ? কেন চলে আসলো এভাবে সেটা জিজ্ঞাসা করা কি ঠিক হবে ?  তারপরেও গেলাম।  কিন্তু না, সে তো বাসে নেই। তাহলে কোথায় গেলো ? এসব চিন্তা করেই ফেরির চারপাশে ঘুড়ে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম কত গুলো ছেলে সিগারেট ফুঁকছে অধরা সেখানেই। ছেলে গুলো তাকে ঘিরেই দাঁড়িয়ে আছে। সে তার চারিদিকে মানব সৃষ্ট দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু ছেলে গুলো ইচ্ছে করেই তাকে ঘিরে রেখেছে। সে বেরিয়ে আসার জন্য যে দিকটায় অগ্রসর হচ্ছে ছেলে গুলোও সে দিকটা ব্লক করে দিচ্ছে। আমি দ্রুত সে দিকটায় অগ্রসর হলাম। কাছাকাছি যেতেই ছেলে গুলো আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে সরে গেলো।  অধরাও সেখান থেকে বেরিয়ে চলে আসলো। অধরাও যখন সেখান থেকে বেরিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে ছেলে গুলো এমন ভাব করে চলে গেলো যেন তারা একজন অপরকেই চিনে না, এতক্ষন যেন কিছুই হয়নি।

ভাবছিলাম এগিয়ে গিয়ে ওদের একটা উচিৎ শিক্ষা দিবো কিন্তু অধরা বেশ দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই অধরা আমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরলো। আমি এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম সে কিছুটা ভয় পেয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে, কিন্তু তার দু-হাতের এই বাঁধন মুক্ত হয়ে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা আমার নেই। মনে হচ্ছিলো যুগ যুগ ধরেও  যদি আমাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয় আমি হাসিমুখে সেই বন্দিত্ব মেনে নিবো। এমন মায়ার বাঁধনে কেউ বেঁধে রাখলে সেই বাঁধন মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে এমন সাধ্য কি কারও আছে ?

যেই ছেলে গুলোকে উচিৎ শিক্ষা দিবো ভেবেছিলাম তারা তো পালিয়েই গেলো আর বন্দি হয়ে গেলাম আমি। চারিদিকে তাকিয়ে যা বুঝলাম সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। কিন্তু কি করবো ? আমি তো এই বন্ধন ছাড়তে চাই না ! কিছুক্ষন পর অধরা নিজেই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। তারপর দ্রুত পায়ে বাসের দিকে এগিয়ে গেলো। আমি সম্ভবত বেশ কিছুটা সময় সম্মোহিত অবস্থায় ছিলাম। চারপাশে কি ঘটে চলেছে তার কোন খেয়ালই ছিলো না। ফেরি ইতোমধ্যে ঘাটের কাছাকাছি চলে এসেছে। আমিও বাসে উঠে পড়লাম।

দেখতে পেলাম অধরা মুখ ফিরে চুপ করে বসে আছে। কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলাম না। বাস চলতে শুরু করলো, মনে হচ্ছিলো এখন বেশ দ্রুত গতিতেই ছুটে চলেছে বাস। দুজনেই অনেক্ষন চুপ ছিলাম। তারপর অধরাই নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো

- প্রথমতঃ আপনাকে ধন্যবাদ, দ্বিতীয়তঃ আমি দুঃখিত ভয় পেয়ে এমনটা করার জন্য।
- তুমি করে বলছিলে, বেশ তো লাগছিলো। আবার আপনি -তে ফিরে গেলে কেন ?
- আচ্ছা বেশ। এখন বলো তুমি কিছু মনে করোনি তো ?
- আমার তো বেশ ভালোই লাগছিলো, কিছু মনে করবো কেন ?
- তাই, একটা মেয়ে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলে খুব ভালো লাগে ?
- জড়িয়ে ধরলে তো ভালোই লাগবে, সেটাই স্বভাবিক। তবে তুমি কিছু না বলেই চলে কেন গিয়েছিলে ? আর ওই জায়গাটায় কেন গিয়েছিলে ?
- আমার ওয়াশরুমে যাবার প্রয়োজন ছিলো তাই, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে এই অবস্থার সম্মুখীন হই।
- ওহ আচ্ছা। আমি ওদেরকে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম, যেন এমনটা আর কখনোই করার সাহস না পায়।
- লাভ নেই এরা শিক্ষা গ্রহন করে না, ভদ্রতা শিক্ষা সবার থাকে না। তবে তোমার সাহস আছে বলতে হবে।
- অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস তো থাকাই উচিৎ।
- কিন্তু সবার সাহস থাকে না, থাকলেও সবাই করে না।

এ কথা বলার পর অধরার মনটা বেশ খারাপ মনে হলো, উদাস হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবার সেই আগের মতোই জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো। আমিও অপেক্ষায় রইলাম সে হয়তো আবার কিছু বলবে, কিন্তু তেমনটা হলো না। মাঝে আমিও এক-দুই বার কথা বলার চেষ্টা করলাম। কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু হ্যা - না উত্তর দিয়েই চুপ হয়ে যাচ্ছিলো। একসময় বাসটা তার গন্তব্যে পৌঁছে গেলো। জানতে পারলাম এটাই শেষ স্টপেজ, আমি অবশ্য এমনিতেও এখানেই নামতাম। দুজনেই নেমে পড়লাম বাস থেকে।
( চলবে )

[ বি. দ্র: এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]

Thursday, March 29, 2018

অসমাপ্ত ( ৫ম পর্ব )

এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ যে কেটে গেছে বলতে পারব না। সময়টাকে তখন বড়ই আপেক্ষিক মনে হচ্ছিল।  হঠাৎ খেয়াল করলাম অধরা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে , হয়ত বিশ্রাম নিচ্ছে বা ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বাতাসে তার খোলা চুলগুলো বার বার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো , কখনও খানিকটা উড়ছিলো। বাতাসে তার ওই ফর্সা গাল টার উপর মেঘকালো চুল গুলো ছুটোছুটি করছিলো।

আমি ইচ্ছে করেই তার সাথে কিছুটা ঘেঁষে বসলাম যাতে বাতাসে তার ওই মেঘকালো চুল গুলো ছুটোছুটি করতে করতে কিছুটা আমার মুখেও এসে পরে। একসময় তাই হলো , বৃষ্টি ভেজা শীতল বাতাসে তার অর্ধ ভেজা চুলের ঘ্রাণ আমায় পাগল করে দিচ্ছিলো। প্রতিটি প্র:শ্বাসে বুক ভরে সেই ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম ; বেশ উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা।

আচমকা পাশ থেকে একটা ধাক্কা অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি অধরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মিটি-মিটি হাসছে।

- কি করছিলে হ্যা ? মেয়ে দেখলেই কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছে করে ? সরি তুমি করে বলে ফেললাম।
- তাহলে আমিও তুমি করেই বলছি ; আর এখন থেকে তুমি করেই বলবে।
- কেন ?
- কারন কাছের মানুষদের তুমি করেই বলতে হয় ?
- কাছের মানুষ কিভাবে হলো ?
- একটু আগেই তো বললে আমি নাকি তোমার কাছে ঘেঁষতে চাইছিলাম।
- হ্যা , সেটাই তো করছিলে।
- জ্বী না ম্যাডাম , আর আমি মেয়েদের পাশে থাকি যাতে অন্য কেউ তাদের বিরক্ত করতে না পারে।
- আহা , অন্যদের সুযোগ না দিয়ে নিজেই সেটা কর।
- তোমার তাই মনে হয় ? ঠিক আছে , আমি তাহলে অন্য কোথাও গিয়ে বসি।
- দরকার নেই , এখানেই থাকো।
- আবার বলবে না তো সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছি ?
- বলবো না ; তবে বেশি কাছে আসার চেষ্টা করবে না।

ইতোমধ্যেই আমরা ফেরি ঘটে চলে আসলাম। ঢাকা থেকে খুলনা যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে এই এক জায়গা যেখানে বেশির ভাগ সময়ই গাড়ির এক লম্বা লাইন থাকে। যেহেতু অনেক সময় লাগবে ফেরি পার হতে , আর গাড়িও এভাবে লাইনেই আটকে থাকবে অনেকক্ষন ; তাই ভাবলাম একটু বাইরে ঘুরে আসি। অনেকেই নামতে শুরু করেছে , আমি উঠে দাঁড়ালাম।  কিছু বলার আগেই অধরাও উঠে দাঁড়াল , একসাথেই বাস থেকে নেমে আসলাম।

পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট , পদ্মা নদীর পাড়। এমনিতেই জায়গাটা আমার বেশ ভাল লাগে, সাধারণতঃ এই জায়গাটা বেশ শান্তই থাকে। তবে মাঝে মাঝেই বেশ কোলাহলে পূর্ণ হয়ে যায়। আজকেও বেশ কোলাহলপূর্ণ তবে সাথে অধরাকে নিয়ে কেন যেন সে সবের প্রতি কোন খেয়ালই ছিল না।

দুজনে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছাকাছি চলে আসলাম। শীতল বাতাস তো ছিলই সাথে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিলো ঘন কালো মেঘ ; মনে হচ্ছিলো যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদীর ঢেউ উপভোগ করছিলাম , পদ্মার উত্তাল ঢেউ। প্রথমে আমিই বলে উঠলাম :

- একটা কথা বলব ?
- কেউ যদি তোমার কাছে আসতে চায় তাকে কি তুমি দূরে সরিয়ে দাও ?
- কেন বলতো ?
- কেন যেন মনে হচ্ছে তাই বললাম।
- ঠিক দূরে সরিয়ে দিই না ; তবে কাছে আসতেও ভয় হয়।
- কেন ? কিসের ভয় ?

- একসময় যারা আমার অনেক কাছের ছিল তারা এখন আমার থেকে অনেক দূরে।
   যাদেরকে ভালবেসে কাছে টেনে নিই কেন যেন তারাই আমাকে কষ্ট দিয়ে দূরে চলে যায়।

- আমাকে কি একটা সুযোগ দেয়া যায় ? কথা দিচ্ছি কখনও কষ্ট দিব না , দূরেও সরে যাব না।
   আর আমি যতক্ষণ তোমার পাশে আছি , কোন ভয় নেই তোমার।

বুঝতে পারছিলাম অধরার ভয়টা ঠিক কোথায়। আসলে পছন্দের আর ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা শুধু মাত্র সেই অনুভব করতে পারে যে এই অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। নারী জীবনের সুখ-দুঃখ ভরা কথা নিয়ে তো অনেক রচনাই হয়েছে যুগ যুগ ধরে। মধ্যযুগেও এমন অনেক রচনা দেখা যায় , যেমনঃ বারোমাসি, ব্রতকথা ইত্যাদি। কবি সেই যুগেও বলেছিলেনঃ

জনম দুঃখিনী আমি দুঃখে গেল কাল। 
যেই ডাল ধরি আমি ভাঙে সেই ডাল।। 

অধরা আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল ; তারপর অন্যদিকে ফিরে তার হাসিটা আড়াল করতে চাইল। এর মধ্যেই আবার মৃদু বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অধরা খানিকটা চুপ করে থেকে বলে উঠল :

- এতো তাড়াহুড়ো করছেন কেন জনাব ? আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।
- আবার হারিয়ে যাবে না তো ?
- হারাবো না ; এখন চলো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।

আমরা ঘাটের পাশেই কোন এক দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি যে আসবে সে তো আর আমার অজানা ছিলো না , তার সাথে যে আমার সখ্য বহু দিনের। আর নারীদের মাঝে মনে হয় হিংসা আর স্বার্থপরতা একটু বেশিই থাকে। তারা তাদের পছন্দের আর ভালোবাসার কাউকে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করতে চায় না।

- আমার ক্ষুধা লেগেছে , তুমি কি খাবে বলো ?
- আমার খুব একটা লাগেনি তো।
- যাইহোক , তুমি না খেলে আমার ভালো লাগবে না।
- ঠিক আছে , কিন্তু আমি তোমাকে খাওয়াবো।
- জ্বী না ম্যাডাম। প্রথম বার আমিই খাওয়াবো। এখন কি খাবে বলো।
- আমার বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করে।
- ঠান্ডা লাগবে তো।
- লাগুক , তবুও খাব।
- বুঝেছি , ডাক্তার আপা অসুখকে ভয় পায় না।

তারপর তার জন্য তারই পছন্দের আইসক্রিম নিয়ে এলাম। ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজেও দুজনে আইসক্রিম খেলাম। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একজন অপরকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। অধরার অবস্থা দেখে আমারই ভয় লাগছিলো। বৃষ্টির মনে হয় তার এই সতীনকে ভাল লাগেনি। তাই থামবার কোনো নাম গন্ধও নেই। আমি বললাম :

- চলো এবার গরম কিছু খাই , চা অথবা কফি। তোমার নিশ্চই ঠান্ডা লাগছে।
- ঠিক আছে চলো। তবে এবার কিন্তু আমি খাওয়াবো।

আমরা চা আর সেদ্ধ ডিম্ খেলাম। বাস ততক্ষনে ঘাটের বেশ কাছেই চলে এসেছে। আমরাও আর দেরি না করে বাসে উঠে পড়লাম।
( চলবে )

[ বি. দ্র: এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]

Friday, April 21, 2017

অসমাপ্ত ( ৪র্থ পর্ব )


[ যখন অনেক চেষ্টা করেও বঙ্কিমের কোন উপন্যাসের নাম মনে করতে পারলেন না ..... ]

- আসলে আমার কোন উপন্যাসের নামই মনে থাকে না।
- বুঝতেই পারছি আপনি বঙ্কিমের অনেক বড় ফ্যান :P .
- আপনি মনে হয় বঙ্কিমের লেখা পড়েন না ?
- চেষ্টা করেছিলাম, ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত  'দুর্গেশনন্দিনী '  পড়তে, তারপর বাকিটা ইতিহাস ......
- মানে ??
- আপনি যেহেতু বঙ্কিমের ফ্যান ব্যাপারটা আপনার বোঝা উচিত।

[ এতক্ষন পর ম্যাডাম বুঝতে পারলেন যে তিনি কি ভুলটা করেছেন ]

- আচ্ছা, আপনি আর কারও লেখা পড়েন না ?
- অনেকের লেখাই পড়েছি তবে শরৎচন্দ্রের পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাই বেশি ভাল লেগেছে।
- আমারও ভাল লাগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা।
- তাই নাকি ? ..... ( থাক আর বললাম নাহ ! )
- হুম ম।  আচ্ছা আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
- কেন ? ঢাকা যাচ্ছি।  এই বাসটা নিশ্চই সিলেট কিংবা বরিশাল যাবে না।
-আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন ? সোজাসুজি উত্তর দিতে পারেন না ?
- Okay, Sorry ! এখন থেকে সোজাসুজি উত্তর করার চেষ্টা করব।

- আপনার কথায় মনে হচ্ছে আপনি দক্ষিণ বঙ্গের মানুষ নন।  খুলনায় কি বেড়াতে এসেছিলেন ?
- বলতে পারেন অনেকটা তাই।  দুৰ্ভাগ্যবশতঃ এখানকার এক নামকরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, বলতে পারেন Accidental Engineer. তাই মাঝে মধ্যে বেড়াতে এসে ক্লাস করতে হয়।

- হাঃহাঃহাঃ

অধরা মুখ আড়াল করে হাসার চেষ্টা করলেও তার অপূর্ব সেই হাসি আমার দৃষ্টি এড়াতে পারল না। মনে হচ্ছিল কোন এক অপ্সরা আমার পাশে বসে আছে আর তার কাজলকালো দুটি চোখের দৃষ্টি শুধু আমারই দিকে তাকিয়ে হাসছে। তার গোলাপি ঠোঁটের কোণায় মুক্তঝরা সেই হাসি, আর সাথে সাথে  লালচে রঙের দুই গালে ফুটে উঠছিলো টোলের রেখা। হাসলে গালে টোল পরে এমন মেয়েদের প্রতি অনেক ছেলেরই দুর্বলতা থাকে, আর সেই মেয়েটি যদি অধরার মত সুন্দরী হয় তাহলে সেই দুর্বলতার শেষ পরিণতি কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। যথাসম্ভব চেষ্টা করলাম নিজেকে সামলে নেয়ার। তারপর জিজ্ঞাসা করলামঃ

- আপনার কথা শুনেও মনে হচ্ছে না যে আপনি দক্ষিণ বঙ্গের মানুষ।
- কি মনে হচ্ছে তাহলে ?
- মনে হচ্ছে আপনি আমার খুব কাছের কেউ।
- মানে ??
- আপনিও নিশ্চই ঢাকায় থাকেন ? কথা শুনে অন্ততঃ তাই মনে হচ্ছে।
- হ্যা, তবে আপনার কাছের কেউ বলতে .... আপনি কি কোন ভাবে আমাকে আগে থেকেই চিনেন ?
- সত্যি বলব নাকি যেটা আপনি বিশ্বাস করবেন সেটাই বলব ?
- মানে ??
- আপনার এই  'মানে ?' প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিব বুঝতে পারছি না। যেহেতু আমরা দুজনেই ঢাকা থাকি তাই বলেছি হয়ত আপনি কাছের কেউই হবেন।
- আপনি কিন্তু আবারও সোজাসুজি উত্তর দিচ্ছেন না।
- আচ্ছা ঠিক আছে। এরপর থেকে সোজাসুজি উত্তর করার জোরালো চেষ্টা করব। তার আগে আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন, আমার কথা তো অনেক বললাম।
- আমার সম্পর্কে বলার তেমন কিছুই নেই। হ্যা, আমিও ঢাকাতেই থাকি আর খুলনা মেডিকেলে পড়ছি MBBS ২য় বর্ষ।

[ বুঝতে পারলাম অধরা আমার থেকে বয়সে কিছুটা বড়ই হবে কেননা আমিতো কেবল ১ম বর্ষে  ভর্তি হয়েছি মাত্র। যাইহোক, এখন এই ব্যাপারটা অধরাকে কিছুতেই বুঝতে দেয়া যাবে না। ]

- ঢাকায় কোথায় থাকেন ?
- ধানমন্ডিতে। তবে আমাদের গ্রামের বাড়ি বগুড়াতে তার মানে উত্তর বঙ্গ।
- আমিও এরকমটাই ধারণা করেছিলাম।

তারপর আমরা দুজনেই হঠাৎ চুপ হয়ে গেলাম, হয়ত কি বলব সেটাই ভাবতে পারছিলাম না অথবা যা বলতে চাইছিলাম, সেটা বলতে পারছিলাম না। অধরা জানালার দিকে ফিরে বাইরে তাকিয়ে রইল। আমি মাঝে মাঝে আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছিলাম। অনেক কিছুই তাকে বলতে চেয়েছিলাম। বলতে চেয়েছিলামঃ  অধরা, হয়ত তোমার সাথে বাস্তবে এটাই আমার প্রথম দেখা কিন্ত এর আগেও বহুবার তুমি এসেছিলে আমার স্বপ্নে, তুমি ছিলে আমার কল্পনায়। তুমি তো আমার অপরিচিতা নও, বহুকাল, বহুযুগ ধরেই তো তুমি আমার পাশে ছিলে। তুমি আমার খুব কাছের কেউ, আমারই আপনজন। নিমাই ভট্টাচার্যের মত বলতে চাইছিলামঃ

'' যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক,
তারা তো পারে না জানিতে
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ
আমার হৃদয়খানিতে। ''
( চলবে )

[ বি. দ্র: এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]

Thursday, January 26, 2017

অসমাপ্ত ( ৩য় পর্ব )

তারপর প্রায় বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল, আমিও প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম; হঠাৎ কারও স্পর্শ অনুভব করলাম। শীতল সেই স্পর্শে যে কারও শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যেতে বাধ্য। চোখ খুলে অধরার দিকে তাকাতেই ,

- আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত।
- সমস্যা নেই, বলুন।
- আপনি যদি আমার সাথে সিটটা এক্সচেঞ্জ করতেন তাহলে খুব ভাল হতো।
- তাই যদি হয়, তবে তাই হোক।

মনে মনে ভাবলাম শুধু সিটটাই কেন এক্সচেঞ্জ করতে চাইলে ? কেন অন্য কিছু নয় ? যাইহোক, তারপর আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করলাম তবে কোন লাভ হল না। দেখলাম অধরা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, হাতে হলুদ রঙের মলাটের একটা বই, তবে বইয়ের ও লেখকের নাম তার হাতে ঢাকা পড়ে আছে। অনুমান করলামঃ হয়ত হুমায়ুন আহমেদের হিমু সিরিজের কোন বই হবে। বেশিরভাগ মেয়েরই পছন্দের বই এইসব। ভাবলাম এবার অধরাকে কিছুটা বিরক্ত করা যাক,

- যদি আমার ভুল না হয় তবে আপনি  হুমায়ুন আহমেদের হিমু সিরিজের কোন বই পড়ছেন, তাই না ?

[ মুখ লুকিয়ে কিছুটা হেঁসে নিল তারপর আমার দিকে ফিরে কিছুটা অবাক হলেও সেটা বুঝতে দিতে চাইল না। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল।  ]

- এতটুকু অনুমান করা খুবই সহজ, তাই না ?

[ আমিও দমে যাবার পাত্র নই, হিমু সিরিজের যত গুলো বই পড়েছিলাম তার মধ্যে হলুদ রঙের মলাট ছিল সম্ভবত ২ টির। আবারও অনুমান করে বললামঃ ]

- হ্যাঁ সেটা হয়ত ঠিক, তবে যদি বলি আপনি হুমায়ুন আহমেদের হিমু সিরিজের "একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁ ঝিঁ পোকা" বইটি পড়ছেন যেটা এই সিরিজের ৯ নাম্বার বই, তবে সেটা কি ভুল হবে ?

- তাহলে আপনি নামটাও দেখে নিয়েছেন ?

- নাহঃ আপনি সেই সুযোগটা আর দিলেন কই ?

- তবে সঠিক কিভাবে বলতে পারলেন ?

[ এতক্ষন পর্যন্ত আমরা একজন অপরজনকে শুধু পাল্টাপাল্টি প্রশ্নই করে যাচ্ছিলাম, তাই এবার আমিই উত্তর দেয়া শুরু করলাম। ]

- ঐ যে, অনুমান করে বলেছি। আমার অনুমান আবার বেশিরভাগ সময় সঠিক হিসেবেই প্রমানিত হয়। 

- তাই নাকি ? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

- আপনি চাইলে অবিশ্বাসও করতে পারেন।

- না, ঠিক তা নয়। তবে মনে হচ্ছে আপনি হুমায়ুন আহমেদ অনেক বেশি পড়েন।

- পড়ি না বললে ভুল হবে, তবে হুমায়ুন আহমেদ অনেক বেশি পড়ি এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। বরং অনেক কম পড়ি, বলতে পারেন কখনো টাইম পাসের জন্য পড়ি।

- জ্বী না স্যার, এটাও আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

- তাহলে ম্যাডাম আপনিই বলুনঃ আপনাকে কিভাবে বিশ্বাস করাতে পারি ? যদি বলি আপনার সবচেয়ে পছন্দের কবি রবীন্দ্রনাথ তাহলে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবেন।

- আশ্চর্য ! আপনি কিভাবে এত সব কিছু জানেন ?

- বলেছিলাম না, আমার অনুমান বেশিরভাগ সময় সঠিক হিসেবেই প্রমানিত হয়।

- আচ্ছা ঠিক আছে মেনে নিচ্ছি। তবে আপনিও মেনে নিন আপনি হুমায়ুন আহমেদ অনেক বেশি পড়েন এবং হুমায়ুন আহমেদ আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক।

- জ্বী না ম্যাডাম।  হুমায়ুন আহমেদ আসলে আপনার প্রিয় ঔপন্যাসিক। আমার পছন্দের ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র।

- তাহলে আমিও মেনে নিব না। আমার পছন্দের ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র।

- তাই নাকি ? ..... হা হা হা  .....

[ এবার দেখলাম অধরা কিছুটা রেগে গেছে, হয়ত আমাকে এভাবে হাসতে দেখেই তার এই প্রতিক্রিয়া। তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম যে অধরা মিথ্যা বলছিল। ]

- হাসছেন কেন ? বঙ্কিমচন্দ্র আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক আপনার কোন সমস্যা আছে ?

- নাহঃ নেই তবে আপনি বঙ্কিমের সব লেখা বুঝতে পারেন ? কোন সমস্যা হয় না ?

- কেন ?  সমস্যা হবে কেন ?

- বেশ বুঝতে পারছি আপনি বঙ্কিমের অনেক বড় ফ্যান। আচ্ছা তার কোন উপন্যাসটা আপনার সবথেকে বেশি ভাল লেগেছে?

[ এইবার মনে হয় ম্যাডাম কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। অনেক ভেবে চিন্তেও বঙ্কিমের কোন উপন্যাসের নাম মনে করতে পারছিলেন না। ]

( চলবে )
[ বি. দ্র :  এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]

Tuesday, October 4, 2016

অসমাপ্ত ( ২য় পর্ব )


বৃষ্টিতে আমি প্রায় বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছিলাম তাই ফ্যানের ঠিক নিচের সিটেই বসে পড়লাম যাতে শার্টটা অন্তত কিছুটা হলেও শুকিয়ে যায়। বৃষ্টির কারনে বাস আসতে আরও খানিকটা সময় লাগতে পারে। তবে আমি ছাড়া এই বিষয়ে আর কারও কোন চিন্তা নেই। অবশ্য এই শিববাড়ী মোড়ের কাউন্টারে তখন আমরা মাত্র তিনজনই অবশিষ্ট আছি। আমি, অধরা আর সেই কাউন্টারে কর্মরত লোকটি।

অধরা তখনও কাউন্টারের সামনে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। হালকা নীল রঙের শাড়িতে যে কোন মেয়েকে সুন্দরী মনে হয় আর এই রমণী যেন সাক্ষাৎ অপ্সরী। যাইহোক, ইচ্ছা না থাকলেও চোখ সরিয়ে নিলাম এবং খবরের কাগজ পড়ায় মনোনিবেশ করলাম। কেননা আমার হাত-পা, চোখ-কান এক কথায় আমার সমগ্র শরীরের উপর যতক্ষন আমার নিয়ন্ত্রন থাকে ততক্ষন সব কিছু ভালোই থাকে আর চারপাশের পরিবেশটাও শান্ত থাকে। তবে যদি কখনও আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তবে সেটা ভয়ানক সুনামির পূর্বাভাস।

বৃষ্টি কিছুটা কমে গেলে অধরা ভেতরে এসে আমার পাশের সিটটা খালি রেখে ঠিক তার পাশের সিটে বসে পড়ল। আড়চোখে আমি সেটা লক্ষ্য করলাম আর মনে মনে ভাবলাম বাসে যদি আমার পাশের সিটটা নিয়ে থাক তবে পুরো রাস্তা তোমাকে আমার পাশে বসেই যেতে হবে। বাসে যাতায়াতের সময় কোন সুন্দরী মেয়ে পাশে বসলে ভাল লাগে সেটা ঠিক, তবে আমি যদি কোন সুন্দরী মেয়ের পাশে বসি তবে সেটা সেই মেয়েটার জন্যই নিরাপদ। কারন রাস্তা-ঘাটে সব ছেলেরা যেমন আমার মত সুশীল না তেমনি আমার নিজের উপর যতটা আস্থা আছে অন্য কারও উপর ততটা নেই।

এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে সময় কেটে গেল টেরই পাইনি। দেখলাম বাস চলে এসেছে, ৭০ নাম্বার বাস। বাসে উঠার আগে ওয়াশরুমে ঢুকলাম, জামা-কাপড় অনেকটাই ভিজে গিয়েছিল তাছাড়া কিছুটা ফ্রেশ হবারও প্রয়োজন বোধ করছিলাম। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম বাসটা ছেড়ে দেয়ার পায়তারা করছে, বৃষ্টির জন্য এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। অধরাকেও দেখতে পেলাম না, হয়ত আমার আগেই বাসে গিয়ে উঠেছে। তাই আমিও আর দেরি না করে উঠে পড়লাম বাসে।

বাসে বেশ ভালোই লোক সমাগম ছিল। আমার সিটটা ছিল E4 , মাঝামাঝি হওয়ায় সুবিধাই ছিল। যেমনটা মনে মনে ভাবছিলাম তেমনটাই হল, অধরার সিটটা ছিল ঠিক আমার পাশেই E3 । কিন্তু সমস্যা হল আমি আসন গ্রহন করার পূর্বেই সে তার আসন দখল করে বসে পড়ায় তাকে সরিয়ে তার পরেই আমি আমার আসনে যেতে পারব। অবস্থা যখন এই রকম তখন আমি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম অধরার সেদিকে খেয়ালই নেই, সে বরং বাইরে ওই দূর আকাশটার দিকেই  আছে। এইবার আমি কিছুটা ঝেড়ে কাশলাম -

- এক্সকিউজ মি !
- ওহ আচ্ছা সরি।

আমি সিটে গিয়ে বসার পরই মনে হল অধরা মুচকি হাঁসছে আর কিছুটা আড়চোখে আমাকে দেখছে। এই রকম পরিস্থিতিতে আমার মত সুবোধ ছেলেদের কিছুটা লজ্জা পাওয়াই স্বাভাবিক। হয়ত সে আমাকে শুরু থেকেই লক্ষ্য করছিল আর আমাকে পাশে এসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও না দেখার ভান করছিল। যদি সত্যিই সে এমনটা করে থাকে তবে তার এই নিখুঁত অভিনয়ের প্রসংশা করতেই হবে। কে জানে এই সব সুন্দরী, ছলনাময়ী মেয়েদের মনে কি আছে? আর তাছাড়া প্রায় সব মেয়েই কম-বেশি পাকা অভিনেত্রী হয়ে থাকে।

অতঃপর বাস শিববাড়ি থেকে সোনাডাঙার দিকে রওয়ানা হল। আমিও সিটটাতে হেলান দিয়ে একটু আয়েশ করে বসলাম। রাস্তা ফাঁকা থাকায় খুব বেশি সময় লাগল না। সোনাডাঙা থেকেই বেশিরভাগ যাত্রী বাসে উঠল। বাস এখানে প্রায় ১০-১৫ মিনিট দেরি করল, একবার ভেবেছিলাম একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি কিন্তু আবার চিন্তা করলাম বার-বার আসা-যাওয়া করলে হয়ত আমার পাশের সুন্দরী যাত্রী কিছুটা বিরক্তি বোধ করবেন তাই বাসেই বসে থাকলাম। দেখতে দেখতে বাসের প্রায় সব গুলো আসনই পূর্ণ হয়ে গেল। খুব বেশি সময় লাগল না, আমরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

রাস্তা বেশ ফাঁকাই দেখতে পেলাম, তেমন কোন কোলাহল নেই। বৃষ্টির পর চারপাশের পরিবেশটা বেশ স্নিগ্ধ আর প্রাণবন্ত বলেই মনে হচ্ছিল। বাসের জানালাটা আরও একটু খুলে দিলাম যাতে বাইরের পরিবেশটা আরও ভালভাবে দেখা যায়। তাছাড়া আমার শার্টটি বৃষ্টিতে বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছিল, সেটাও শুকানো প্রয়োজন। হয়ত আমার সেই আধ-ভেজা অবস্থা দেখেই অধরা কিছুটা মুচকি হেসেছিল। এখন বাতাসে এই ভেজা শার্টটা শুকাতেও হয়ত বেশ খানিকটা সময় লাগবে।

আকাশটা এখন বেশ পরিষ্কার তবে বাতাসটা বেশ ভারী মনে হচ্ছিল। এই সময়টাতে আদা-লেবু দিয়ে কড়া এক কাপ চা খাওয়া আর গিটারে পরিচিত সেই গানের মুহূর্তগুলো যে কতোটা মিস করছি তা কোনভাবেই ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। আপাততঃ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনেই সেই অনুভূতিটুকু নেয়ার চেষ্টা করাটাই শ্রেয় মনে হল। গান শুনতে শুনতে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। বৃষ্টির পর বৃষ্টির গানগুলো শুনলে এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। পাশ থেকে অধরা কিছু বলছিল মনে হল। তার দিকে না ফিরেই কি বলছিল তা শোনার চেষ্টা করলাম।

- এক্সকিউজ মি ! আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি জানালার পাশটায় বসতে চাচ্ছিলাম।

ওমা ! বলে কি এই মেয়ে? আপাতত কোনভাবেই এই অনুভূতিটুকু বিসর্জন দিতে পারব না। তাই শুনেও না শোনার ভান করলাম। কানে হেডফোন থাকায় এমন ভাব করলাম যেন চারপাশে কি হচ্ছে আমি তার কিছুই জানি না। এটা পূর্বের ঘটনার প্রতিশোধ নয়, পাকা অভিনেত্রীদের সাথে অভিনয় করাটা দোষের কিছু নয় বরং দুর্লভ একটা সুযোগ লুফে নেয়ার মতোই মজার একটা ব্যাপার। 
( চলবে )
[ বি. দ্র :  এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]

Friday, September 2, 2016

অসমাপ্ত ( ১ম পর্ব )

সঠিক দিন, তারিখ, ক্ষণ কোন কিছুই মনে নেই। কেবল এতটুকুই মনে আছে সেদিন আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেছিল। হয়ত প্রকৃতিও আমাদের প্রথম সাক্ষাৎকে তার অনিন্দ্যসুন্দর ভঙ্গিমায় উদযাপন করে নিয়েছিল। অনেক কারনেই ঢাকার বাইরে অন্য যে শহরটাতে আমার সবথেকে বেশি ভ্রমন করা হয়েছে সেটি হল খুলনা শহর। আর খুলনা শহরে আমার ফেলে আসা অনেক স্মৃতির মধ্যে সবথেকে পছন্দের স্মৃতিই ছিল তার সাথে কাটানো কিছু সময়।

আমি জানি না তার নামটি কি ছিল, জিজ্ঞাসা করিনি, হয়তোবা তাকে হারিয়ে ফেলার কথাটাও তখন চিন্তা করিনি। যাইহোক, লেখার সুবিধার্থে আর পাঠকের কাছে লেখাটি সহজবোধ্য করার জন্য তার একটা নাম দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। আমার জীবনে অনেকটা স্বপ্নের মতোই সে এসেছিল, যে স্বপ্নের ব্যাপ্তিকাল ছিল মাত্র সাড়ে ছয় ঘন্টা। সেই স্বপ্ন, যা ছিল কাল্পনিক, অলীক যাকে আজও শুধু আমিই অনুভব করতে পারি। তাকে ধরা যায় না বা ছোঁয়া যায় না, তাই তার নাম দেয়া যাক অধরা।

সকাল সকাল নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম মেস থেকে। সকাল পৌঁনে দশটায় বাস ছাড়বে খুলনা শিববাড়ি মোড় থেকে তারপর দশটায় সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকার উদেশ্যে ছেড়ে যাবে। গতরাতেই কথা হয়েছিল সেই অনুযায়ী আমার সাথে আমার মতো আরও এক হতভাগার একই বাসে যাবার কথা ছিল। কিন্ত সকালেই সে ফোন করে জানিয়ে দিল যেতে পারছে না, অতি মাত্রায় সিরিয়াস শিক্ষার্থী হলে যা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, ল্যাব, পরীক্ষা সে তো আমারও ছিল। সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়েই তো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে কবে ছুটি দিবে তার জন্য আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়, তার থেকে বরং আমিই কিছুদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ছুটি দিয়ে দিলাম। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় কেন স্কুল কলেজে থাকতেও আমার এই ছুটি দেয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। কেউ আসুক বা নাই আসুক, ছুটি পাক বা নাই পাক আমি আপাতত এই প্যারাময় জীবন থেকে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরে আসি।

কাউন্টারে পৌঁছে আবারও সেই হতভাগাকে ফোন দিলাম তারপর তার টিকেটটা বাতিল করে আমি বাসের উদ্দেশ্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এ.কে ট্রাভেলস এর কাউন্টার, ঢাকা-খুলনা রুটের এক অপ্রতিদ্বন্দী বাস সার্ভিস। বেশিরভাগ সময় এই বসেই আসা-যাওয়া করতাম তাই এখানকার লোকজনও পরিচিত ছিল। ফোনে আগেই বলে রেখেছিলাম তাই নতুন করে আর কিছু বলারও প্রয়োজন হয়নি। বাস আসতে আরও প্রায় ২৫ মিনিট লাগবে। পরিচিত থাকায় কিছু এক্সট্রা সুবিধা পেতাম, ওরা চা অফার করল আমিও চা খেতে খেতে ঐ দিনের পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম এক সুন্দরী রমণী কাউন্টারে এসে রানিং বাসের টিকেট চাইছে। সম্ভবত যেই টিকেটটা আমি একটু আগে বাতিল করেছিলাম সেটিই একমাত্র খালি সিট্ ছিল, না হলে হয়ত কোন কারনে ঐ সিটটাই তার পছন্দ হয়েছিল, কে জানে? কাউন্টারের লোকটা বলছিল যে এই সিটটা একটু আগেই বাতিল করা হয়েছে তাই তাকে দেয়া সম্ভব হচ্ছে নয়ত পরবর্তী বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হত।

যাইহোক, আমিও চা শেষ করে উঠে পড়লাম আর বাস আসতে যেহেতু আরও বেশ কিছুটা সময় বাকি তাই বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। সকাল থেকে আকাশ কিছুটা মেঘলা থাকলেও এতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল না। বাতাসের গতি-বিধিতেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। মনে হচ্ছে খুব শীঘ্রই বৃষ্টি শুরু হবে। আমিও তাই বৃষ্টির অপেক্ষা করতে লাগলাম। বৃষ্টি আসবে আর আমি ভিজব না এমনটা আবার হয় নাকি? তাহলে তো শুধু আমার না বৃষ্টিরও খারাপ লাগবে।

ছোটবেলা থেকেই আমি বৃষ্টিবিলাসী, বৃষ্টির সাথে যেন আমার অনেক পুরোনো দিনের সখ্য। তাছাড়া আমার জীবনের সবথেকে বড় দুর্ঘটনাটি তখনও ঘটেনি তাই এখনকার মত বৃষ্টিকে এড়িয়ে চলতাম না সেই সময়। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কল্পনায় হারিয়ে যাওয়াটাই তখন স্বাভাবিক ছিল যেমনটা এখন আমার কাছেই কল্পনার বিষয় মনে হয়। এখন যদি বৃষ্টিতে ভিজতে হয় তবে সেটা একান্ত বাধ্য হয়েই ভিজতে হয়, যখন অন্য কোন উপায়ান্তর থাকে না। তাছাড়া এখন এই বৃষ্টি আর আমাকে সেই পুরোনো দিনের আবেগ, অনুভূতি দিতে পারে না। পুরোনো সেই সময়ের সাথে পুরোনো সেই বৃষ্টিটাও যেন হারিয়ে গেছে।

ঝড়ো বাতাস বইছে, রাস্তায় ছুটছে সবাই। যে যেখানে পারছে আশ্রয় নিচ্ছে। যদি এখন সাথে প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সহ ব্যাগটা না থাকত আর যদি ঢাকার উদ্যেশে রওয়ানা না দিতাম তবে ঝড়ো বাতাস উপেক্ষা করেই বৃষ্টিতে ভিজতাম। আমি সকলের শেষে অর্ধেকটা ভেজা অবস্থায় কাউন্টারে প্রবেশ করলাম। সে সময় কাউন্টারে আমরা তিন চার জন লোক ছাড়া আর তেমন কেউ ছিল না। দেখলাম সেই সুন্দরী রমণীটি কাউন্টারের সামনে এক কোনায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। ঝড়ো বাতাসে তার বাঁধনহারা এলোমেলো চুলগুলো তাকে বড্ড বিরক্ত করছিল। তবুও সে তার দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিল ঐ সুদূর আকাশপানে, যেখান থেকে মেঘ গুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে। এই সুনয়না, এলোকেশী, সুহাসিনী, অপরূপা রূপসীই হচ্ছে অধরা।
( চলবে )
[ বি. দ্র :  এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]