Wednesday, April 1, 2020

অসমাপ্ত ( ৭ম পর্ব )

বিদায় বেলায় দুজনেরই হয়ত কিছু বলার ছিল তবে কেন যেন কেউই কিছু বলতে পারছিলাম না। বিচ্ছেদের এই সময়টা যে আসবে সে তো আমাদের জানাই ছিল। মাতৃভাষায় এত লক্ষ সহস্রাধিক শব্দ থাকা সত্ত্বেও মনের কথাটি বলার জন্য উপযুক্ত কোন শব্দ কেন খুঁজে পাচ্ছিলাম না? রবীন্দ্রনাথের মত ভাষা আমার নেই, থাকলে হয়ত বলতে পারতাম -

``যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।"

বেশ কিছুক্ষন ইতস্ততঃ করার পর সে বলে উঠল - ``কিছু বলবে?" কি বলব আমি? কিভাবে তাকে বুঝাব যে আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি ? আমি শুধু  তাকিয়ে রইলাম। কেন যেন আমার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না ওর। কথাটি বলার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা বলতে চাইছিল। কোন এক অজানা কারণে কথাটি তার কণ্ঠ থেকে মুখ অবধি পৌঁছাতে পারছিলো না। চারিদিকে মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। সবাই ব্যাস্ত, ছুটে চলেছে আপন কর্মক্ষেত্রে। আমরা দুটি নিশ্চল প্রাণী সেখানে বেমানান।

হঠাৎ কোন কিছু না বলেই ঘুরে চলতে শুরু করল অধরা। আমি তখনও অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম, এতক্ষনে আমার চেতনা ফিরে আসল। তাকে যে অনেক কথা বলার ছিল, কি বলব তাকে আমি? আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? ভালবাসি?

জীবন নদীতে স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বাইতে বাইতে আজ আমি ক্লান্ত। মনে হচ্ছিল হাল ধরার দায়িত্বটা কাউকে দেয়া উচিৎ। এতটা অসহায় আর কখনো মনে হয়নি, এতটা ক্লান্তিও আর কখনো অনুভব করিনি। তবে কি সত্যিই তাকে ভালবেসে ফেলেছি? নাহ ! আমার মত একজন আত্মসচেতন আর চেতনাবোধ সম্পন্ন ছেলের পক্ষে এরকম চিন্তা করাটা একদমই অনুচিত।

যদি বলি ভালবাসি তবে মিথ্যা বলা হবে। কেননা `Love at first sight' এ আমি বিশ্বাস করি না, বরং সেটা `Lust at first sight' হতে পারে। প্রথম দেখায় কাউকে ভাল লাগতেই পারে তবে ভালবাসা এতটা সস্তা নয়। ভালবাসা অমূল্য, শুধুমাত্র চোখের জলে তার মূল্য দেয়ার চেষ্টা করাটাও বৃথা। আপনি যদি কাউকে সত্যিই ভালবেসে থাকেন তবে আপনার বুকে হাত রেখে, চোখ বন্ধ করে তার কথা ভাবুন আর বলুন ভালবাসি। দেখবেন আপনার হৃদয় থেকেও তেমনটাই উত্তর পাবেন। তাছাড়া যার জন্য আমার দু-ফোঁটা চোখের জলও ঝড়েনি তাকে আর যাই হোক ভালবাসি বলতে পারি না।

তবে কি বলব তোমাকে অনেক ভাল লেগেছে, এতটা কম সময়ে এতটা বেশি ভাল আর কাউকে লাগেনি, এতটা কাছেও কেউ আসতে পারেনি। আরও কিছু সময় পেলে হয়ত . . . নাহ থাক ! এরকমটা বললে হয়ত ভুল কিছু ভেবে বসতে পারে অথবা এটাও ভাবতে পারে যে আমি তার প্রতি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছি। তাহলে কী বলব আমি ?

সময় পার হয়ে যাচ্ছে, ইতোমধ্যে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে অধরা। চারপাশে মানুষের ভিড় বেড়েই চলেছে। কিছু বলতে হবে তাকে, আবার কখনো আমাদের দেখা হবে কি না? তার ফোন নাম্বার, বাসার ঠিকানা না হোক অন্তত ফেসবুক আইডিটা তো চাইতেই পারি। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, ততক্ষণে সে অনেকটাই দূরে চলে গেছে। কিভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করব? কি বলে ডাকব তাকে? আমি যে তার নামটাও জানি না। ক্রমশঃ আমাদের মাঝে দূরত্ব বেড়েই চলেছে, সে চলে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে।

কলেজ জীবন থেকেই মিউজিক করতাম, একটা ব্যান্ড ও ছিলো আমার যার গিটারিস্ট এবং ভোকালিস্টও ছিলাম। 'মহীনের ঘোড়াগুলি' - ব্যান্ডের সেই গানটি কখনো স্টেজে না গাইলেও সেই সময় সেটাই আমার বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হচ্ছিলো :

``ভেবে দেখেছো কি
তারা-রাও যতো আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে ।।"

একটি বারের জন্যেও কি ফিরে তাকাবে না অধরা? দয়া করে একটি বার হলেও ফিরে তাকাও, না হয় দূর থেকেই শেষ বারের মত তোমায় দেখব। অধরা যতই দূরে চলে যাচ্ছে তাকে একটি বার অন্তত দেখার আকাঙ্খাও ততটাই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সেই সাথে তাকে হারিয়ে ফেলার আশঙ্কাও আমাকে ঘিরে ফেলেছিল। চিৎকার করতে চাইলেও তা পারছিলাম না, এই ভিড়ের মধ্যে কে-ই বা আমার চিৎকার শুনবে। অধরাকে শেষ বারের মত দেখার আশাটাও যখন বিসর্জন দিতে বসেছিলাম ঠিক তখনই ভাগ্যদেবতা আমার প্রতি মুচকী হাসলেন।

দূরে একটা যাত্রী ছাউনির নিচে গিয়ে অধরা দাঁড়িয়ে পড়ল আর আমি তখনও লোক-জনের ভিড়ের ঠিক কেন্দ্র বিন্দুতে। এই বার অধরা পেছনে ফিরে তাকাল, হাজারো মানুষের মাঝে তার দৃষ্টি ঠিকই আমাকে খুঁজে পেয়েছিল। আমি আর এগিয়ে চলার শক্তি পাচ্ছিলাম না, তাকে দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার দিকে তাকিয়ে কিছুটা হাসল সে তারপর বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাওয়া তার চুল গুলো কপালের নিচ থেকে, চোখের ঠিক পাশ দিয়ে গাল পর্যন্ত টেনে কানের পাশে সরিয়ে দিল সেই সাথে তার গোলাপি ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গেলেও তার সেই নিষ্পাপ চাহনি কখনো ভুলতে পারব বলে মনে হয় না।

কোথা থেকে যেন আবার এগিয়ে চলার শক্তি সঞ্চারিত হল আমার শরীরে, হয়ত অধরার চাহনিতেই সেই শক্তি লুকায়িত ছিল। আবার ভিড় ঠেলে এগিয়ে চলতে শুরু করলাম, আগের চেয়ে দ্বিগুন গতিতে। কিন্ত এইবার ভাগ্যদেবতা মুচকী নয় অট্টহাসি হাসলেন, কোথা থেকে যেন সাদা একটা প্রাইভেটকার এসে সেই যাত্রী ছাউনিটার সামনে থামল আর অধরা আমার দিকে ফিরে তার সেই ভুবনভুলানো মুক্তাঝড়া হাসি দিয়ে গাড়িটাতে উঠে পড়ল। আর তারপর বাকিটা ইতিহাস ...

সেই ইতিহাস আর লিখতে চাই না, ভেবেছিলাম এই গল্পটাও কখনো লিখব না। তবে কেন লিখলাম ? আসলে যা অসমাপ্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, থেকে যায় কিছু কথা, কিছু স্মৃতি। গল্পের শেষ কোথায় তা আমরা জানি না, কখনো তার সমাপ্তি হয়, কখনো হয় না।

সেদিনের পর থেকে আজ অবধি অধরা আর আমার কাছে ধরা দেয়নি। জানিনা, আর কখনো আমাদের দেখা হবে কি না। শুনেছিলাম, হারম্যান ভাইলের আবিষ্কারের (১৯২৯) প্রায় ৮৫ বছর পর ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞনীরা (ভাইল ফার্মিয়ন) অধরা কণার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। তেমনি হয়ত আমিও কোন একদিন অধরাকে খুঁজে পাব।

যদি আবার কখনও আমাদের দেখা হয়েই যায় তবে না বলা সেই কথা গুলো অবশ্যই তাকে বলব। কী বলব, কিভাবে বলব এসব নিয়ে আর চিন্তা করব না। তার চোখের দিকে তাকিয়ে যা মনে আসবে বলে ফেলব। যদি আবারও ভাষা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা দেখা দেয় তবে তার পূর্বে এতটুকু অবশ্যই বলব - আমার দেখা বিধাতার সুন্দরতম সৃষ্টির অন্যতম নিদর্শন তুমি। দয়া করে তোমার নামটা আমায় বলবে কি ?
(সমাপ্ত )

0 comments:

Post a Comment