এসব কিছু ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ যে কেটে গেছে বলতে পারব না। সময়টাকে তখন বড়ই আপেক্ষিক মনে হচ্ছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম অধরা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে , হয়ত বিশ্রাম নিচ্ছে বা ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বাতাসে তার খোলা চুলগুলো বার বার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিলো , কখনও খানিকটা উড়ছিলো। বাতাসে তার ওই ফর্সা গাল টার উপর মেঘকালো চুল গুলো ছুটোছুটি করছিলো।
আমি ইচ্ছে করেই তার সাথে কিছুটা ঘেঁষে বসলাম যাতে বাতাসে তার ওই মেঘকালো চুল গুলো ছুটোছুটি করতে করতে কিছুটা আমার মুখেও এসে পরে। একসময় তাই হলো , বৃষ্টি ভেজা শীতল বাতাসে তার অর্ধ ভেজা চুলের ঘ্রাণ আমায় পাগল করে দিচ্ছিলো। প্রতিটি প্র:শ্বাসে বুক ভরে সেই ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম ; বেশ উপভোগ করছিলাম ব্যাপারটা।
আচমকা পাশ থেকে একটা ধাক্কা অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি অধরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে মিটি-মিটি হাসছে।
- কি করছিলে হ্যা ? মেয়ে দেখলেই কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছে করে ? সরি তুমি করে বলে ফেললাম।
- তাহলে আমিও তুমি করেই বলছি ; আর এখন থেকে তুমি করেই বলবে।
- কেন ?
- কারন কাছের মানুষদের তুমি করেই বলতে হয় ?
- কাছের মানুষ কিভাবে হলো ?
- একটু আগেই তো বললে আমি নাকি তোমার কাছে ঘেঁষতে চাইছিলাম।
- হ্যা , সেটাই তো করছিলে।
- জ্বী না ম্যাডাম , আর আমি মেয়েদের পাশে থাকি যাতে অন্য কেউ তাদের বিরক্ত করতে না পারে।
- আহা , অন্যদের সুযোগ না দিয়ে নিজেই সেটা কর।
- তোমার তাই মনে হয় ? ঠিক আছে , আমি তাহলে অন্য কোথাও গিয়ে বসি।
- দরকার নেই , এখানেই থাকো।
- আবার বলবে না তো সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছি ?
- বলবো না ; তবে বেশি কাছে আসার চেষ্টা করবে না।
ইতোমধ্যেই আমরা ফেরি ঘটে চলে আসলাম। ঢাকা থেকে খুলনা যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে এই এক জায়গা যেখানে বেশির ভাগ সময়ই গাড়ির এক লম্বা লাইন থাকে। যেহেতু অনেক সময় লাগবে ফেরি পার হতে , আর গাড়িও এভাবে লাইনেই আটকে থাকবে অনেকক্ষন ; তাই ভাবলাম একটু বাইরে ঘুরে আসি। অনেকেই নামতে শুরু করেছে , আমি উঠে দাঁড়ালাম। কিছু বলার আগেই অধরাও উঠে দাঁড়াল , একসাথেই বাস থেকে নেমে আসলাম।
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট , পদ্মা নদীর পাড়। এমনিতেই জায়গাটা আমার বেশ ভাল লাগে, সাধারণতঃ এই জায়গাটা বেশ শান্তই থাকে। তবে মাঝে মাঝেই বেশ কোলাহলে পূর্ণ হয়ে যায়। আজকেও বেশ কোলাহলপূর্ণ তবে সাথে অধরাকে নিয়ে কেন যেন সে সবের প্রতি কোন খেয়ালই ছিল না।
দুজনে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে নদীর কাছাকাছি চলে আসলাম। শীতল বাতাস তো ছিলই সাথে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিলো ঘন কালো মেঘ ; মনে হচ্ছিলো যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নদীর ঢেউ উপভোগ করছিলাম , পদ্মার উত্তাল ঢেউ। প্রথমে আমিই বলে উঠলাম :
- একটা কথা বলব ?
- কেউ যদি তোমার কাছে আসতে চায় তাকে কি তুমি দূরে সরিয়ে দাও ?
- কেন বলতো ?
- কেন যেন মনে হচ্ছে তাই বললাম।
- ঠিক দূরে সরিয়ে দিই না ; তবে কাছে আসতেও ভয় হয়।
- কেন ? কিসের ভয় ?
- একসময় যারা আমার অনেক কাছের ছিল তারা এখন আমার থেকে অনেক দূরে।
যাদেরকে ভালবেসে কাছে টেনে নিই কেন যেন তারাই আমাকে কষ্ট দিয়ে দূরে চলে যায়।
- আমাকে কি একটা সুযোগ দেয়া যায় ? কথা দিচ্ছি কখনও কষ্ট দিব না , দূরেও সরে যাব না।
আর আমি যতক্ষণ তোমার পাশে আছি , কোন ভয় নেই তোমার।
বুঝতে পারছিলাম অধরার ভয়টা ঠিক কোথায়। আসলে পছন্দের আর ভালবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া কষ্ট কতটা যন্ত্রণাদায়ক সেটা শুধু মাত্র সেই অনুভব করতে পারে যে এই অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। নারী জীবনের সুখ-দুঃখ ভরা কথা নিয়ে তো অনেক রচনাই হয়েছে যুগ যুগ ধরে। মধ্যযুগেও এমন অনেক রচনা দেখা যায় , যেমনঃ বারোমাসি, ব্রতকথা ইত্যাদি। কবি সেই যুগেও বলেছিলেনঃ
জনম দুঃখিনী আমি দুঃখে গেল কাল।
যেই ডাল ধরি আমি ভাঙে সেই ডাল।।
অধরা আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল ; তারপর অন্যদিকে ফিরে তার হাসিটা আড়াল করতে চাইল। এর মধ্যেই আবার মৃদু বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অধরা খানিকটা চুপ করে থেকে বলে উঠল :
- এতো তাড়াহুড়ো করছেন কেন জনাব ? আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।
- আবার হারিয়ে যাবে না তো ?
- আবার হারিয়ে যাবে না তো ?
- হারাবো না ; এখন চলো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
আমরা ঘাটের পাশেই কোন এক দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি যে আসবে সে তো আর আমার অজানা ছিলো না , তার সাথে যে আমার সখ্য বহু দিনের। আর নারীদের মাঝে মনে হয় হিংসা আর স্বার্থপরতা একটু বেশিই থাকে। তারা তাদের পছন্দের আর ভালোবাসার কাউকে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করতে চায় না।
- আমার ক্ষুধা লেগেছে , তুমি কি খাবে বলো ?
- আমার খুব একটা লাগেনি তো।
- যাইহোক , তুমি না খেলে আমার ভালো লাগবে না।
- ঠিক আছে , কিন্তু আমি তোমাকে খাওয়াবো।
- জ্বী না ম্যাডাম। প্রথম বার আমিই খাওয়াবো। এখন কি খাবে বলো।
- আমার বৃষ্টিতে ভিজে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছা করে।
- ঠান্ডা লাগবে তো।
- লাগুক , তবুও খাব।
- বুঝেছি , ডাক্তার আপা অসুখকে ভয় পায় না।
তারপর তার জন্য তারই পছন্দের আইসক্রিম নিয়ে এলাম। ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজেও দুজনে আইসক্রিম খেলাম। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একজন অপরকে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। অধরার অবস্থা দেখে আমারই ভয় লাগছিলো। বৃষ্টির মনে হয় তার এই সতীনকে ভাল লাগেনি। তাই থামবার কোনো নাম গন্ধও নেই। আমি বললাম :
- চলো এবার গরম কিছু খাই , চা অথবা কফি। তোমার নিশ্চই ঠান্ডা লাগছে।
- ঠিক আছে চলো। তবে এবার কিন্তু আমি খাওয়াবো।
আমরা চা আর সেদ্ধ ডিম্ খেলাম। বাস ততক্ষনে ঘাটের বেশ কাছেই চলে এসেছে। আমরাও আর দেরি না করে বাসে উঠে পড়লাম।
( চলবে )
[ বি. দ্র: এই গল্পের চরিত্র ও ঘটনাবলীর সাথে কারও ব্যাক্তিগত জীবনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য খোঁজাটা নিরর্থক, কারও সাথে কোনভাবে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র। ]
0 comments:
Post a Comment