আমরা বাঙালিরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই উদার মনের আর তাই খুব সহজেই বিদেশি সংস্কৃতি গুলোকে আপন করে নিতে পারি। ইংরেজি ফেব্রুয়ারি (February) মাসের বিশেষত্ব এখন আর শুধুই ২১ শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। সত্যি বলতে কি এখনকার যুবসমাজ এই দিবসটি সম্পর্কে কতটা জ্ঞান রাখে সেই বিষয়েও হয়ত অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে। গত বছর টিভিতে দেখলাম, ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা এক তরুণীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলঃ ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে কি হয়েছিল ?
তারপর আর নাই বা বললাম; বুঝতেই পারছেন যে সেই প্রশ্নের উত্তরে তরুণী এক নতুন ইতিহাস তৈরী করেছিল যা শুনলে হয়ত আমাদের ইতিহাসবিদগণ নিজেরাই ইতিহাসে পরিণত হয়ে যেতে পারেন। তবে আমাদের তরুণ সমাজ যা করেছে তা হল পুরো ১ সপ্তাহ ব্যাপী বিশ্ব ভালবাসা দিবস তথা ভালবাসা সপ্তাহ পালন। ভাবছেন, বিশ্ব ভালবাসা দিবস তো শুধু ১৪ ই ফেব্রুয়ারি তাই না ? তাহলে একনজর দেখে নিন সম্পূর্ণ ভালবাসা সপ্তাহটিকে :
Rose Day – February 7
Propose Day – February 8
Chocolate Day – February 9
Teddy Day – February 10
Promise Day – February 11
Hug Day – February 12
Kiss Day – February 13
Valentine’s Day – February 14
ভালবাসা দিবস বলে কথা ! মাত্র ১ দিনে কি আর হয় ? আমি মনে হয় কিছুটা পুরোনো জেনারেশনের মানুষ তাই হয়ত এই দিনটির মাহাত্ম সঠিকভাবে এখনও বুঝতে পারি নাই। আমার মত আরো যারা আছেন তাদেরই বলছি, চলুন ভালবাসা সপ্তাহ সম্পর্কে একটু বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
প্রথমেই আসা যাক Rose Day (February 7) এর কথায়। এই দিন প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পর লাল গোলাপ বিনিময় করে নিজেদের ভালবাসার প্রকাশ ঘটায়। যদিও এই কাজটি এখন একতরফা ভাবে শুধু প্রেমিকগণই করে থাকে। লাল গোলাপকে মনে করা হয় ভালবাসার প্রতীক (যেমনঃ সাদা গোলাপ শান্তির প্রতীক, হলুদ গোলাপ মিত্রতার প্রতীক)। ইংরেজি 'Rose' এর বর্ণ গুলোকে বিন্যাস করলে একটি হয় 'Erose' আর গ্রীক মিথ অনুযায়ী ইরোস হচ্ছে প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। আর ভালবাসা সপ্তাহের শুরুতেই এই দেবীকে খুশি করার প্রয়াস করা হয়ে থাকে।
Rose Day দিয়ে ভালবাসা সপ্তাহ শুরু হবার পরদিনই হচ্ছে Propose Day (February 8) অর্থাৎ, লাল গোলাপ দেয়ার পর সঙ্গত কারনেই প্রেম নিবেদন করার বিষয়টি চলে আসে আর তাই এই দিনটির অবতারনা করা হয়।
Propose Day এর পর (প্রেম নিবেদনে সফল হওয়ার পর) Chocolate Day (February 9), এই দিনে সম্ভবত প্রেমিক-প্রেমিকাগণ একটু মিষ্টিমুখ করে। তাছাড়া এই যুগের তরুণীরা যেহেতু চকলেট খুব পছন্দ করে (তাই হয়ত ইদানিং চকলেট ফ্লেভারের প্রচলন বেশি) তাই মিষ্টিমুখ করার জন্য চকলেটই সবথেকে বেশি মানানসই।
মিষ্টিমুখ তো করা হয়ে গেল, মিষ্টিমুখ করলে একটা গিফট তো দিতেই হয়; তাই Teddy Day (February 10) এর প্রচলন। কেননা, রমণীদের কাছে Teddy Bear (এক প্রকার খেলনা ভালুক) খুবই প্রিয়। আমার কথা বিশ্বাস না হইলে একটা ভালুক কিনা কোন রমণীকে উপহার দিয়াই দেখেন !
অনেক কিছুই তো হইল, এইবার একটা কমিটমেন্ট দরকার। Promise Day (February 11) তে সেই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়।
এরপর আসে Hug Day (February 12), প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবার পর সেটাকে আরও জোরদার করার প্রয়াস আর কি !
তারপর হচ্ছে Kiss Day (February 13), এর সম্পর্কে আর আলাদা ভাবে বলার কিছুই নেই; নাম দেখেই বুঝতে পারছেন। পাশাপাশি আবার এই দিন হচ্ছে বসন্তের প্রথম দিন অর্থাৎ ১লা ফাল্গুন। তরুণ-তরুণীরা হলুদ পোশাকে বসন্ত উৎসবও এই দিনেই পালন করে থাকে।
কেউ একজন বলেছিলেন এইদিন হচ্ছে তাদের হলুদ সন্ধ্যা আর পরদিন (১৪ই ফেব্রুয়ারী) তাদের বিয়ে। আমাদের তরুণ-তরুণীরা আবার যে কোন দিবসকেই তাদের প্রেমের জন্য উপযুক্ত দিন হিসেবে ঠিক করে নিতে সিদ্ধহস্ত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোন দিবস কিংবা রজনী সবই তাদের প্রেমের জন্য উপযুক্ত অর্থাৎ, সবই ভালবাসা দিবস (কিংবা রজনী)।
যাইহোক, এতক্ষন পর্যন্ত যে সকল Day এর কথা বলা হয়েছে তার প্রচলন মূলত ভারতীয় উপমহাদেশেই বেশি এবং এগুলোর ঐতিহাসিক তেমন কোনো মর্যাদা নেই; তবে Valentine’s Day (February 14) প্রায় সারা বিশ্বেই একযোগে পালন করতে দেখা যায়। এই দিন মূলত প্রিয়জনদের উপহার হিসেবে valentine card দেয়া হয়।
এই দিনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়: সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম অনুসারে এ দিনের নামকরন তবে ক্যাথলিক চার্চ অনুযায়ী কমপক্ষে তিনজন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নাম পাওয়া যায়।
শুরুতেই বলতে হয় প্রায় সাড়ে সতেরশো বছর পূর্বের একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা। ২৭০ সালের তখনকার দিনে ইটালীর রোমে শাসন করতেন রাজা ক্লডিয়াস-২, যিনি মোটেই ভাল শাসক ছিলেন না। সাধারন জনগন তাকে চাইত না। রাজা তার সুশাসন ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে রাজ দরবারে তরুন যুবকদের নিয়োগ দিলেন। আর যুবকদের দায়িত্বশীল ও সাহসী করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি রাজ্যে যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কারন, রাজা বিশ্বাস করতেন বিয়ে মানুষকে দূর্বল ও কাপুরুষ করে। বিয়ে নিষিদ্ধ করায় পুরো রাজ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হলো। এ সময় সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক জনৈক যাজক গোপনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন; তিনি পরিচিতি পেলেন 'ভালবাসার বন্ধু' বা ‘Friend of Lovers’ নামে। কিন্তু তাকে রাজার নির্দেশ অমান্য করার কারনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে আটক করা হল। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কারারুদ্ধ হওয়ার পর প্রেমাসক্ত যুবক-যুবতীদের অনেকেই প্রতিদিন তাকে কারাগারে দেখতে আসত এবং ফুল উপহার দিত। তারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক কথা বলে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে উদ্দীপ্ত রাখত। জেলে থাকাকালীন ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় হয় জেল রক্ষক আস্ট্রেরিয়াসের সাথে। আস্ট্রেরিয়াস জানতো ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পর্কে। তিনি তাকে অনুরোধ করেন তার অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে। ভ্যালেন্টাইন পরবর্তীতে মেয়েটির দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। এতে মেয়েটির সাথে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। অনেকক্ষণ ধরে তারা দু’জন প্রাণ খুলে কথা বলত। এভাবে এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যায়। রাজা তার এই আধ্যাত্মিকতার সংবাদ শুনে তাকে রাজ দরবারে ডেকে পাঠান এবং তাকে রাজকার্যে সহযোগীতার জন্য বলেন। কিন্তু ভ্যালেন্টাইন বিয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা না তোলায় সহযোগীতায় অস্বীকৃতি জানান। এতে রাজা ক্ষুদ্ধ হয়ে তার মৃত্যুদন্ড ঘোষনা করেন। মৃত্যু দন্ডের ঠিক আগের মূহুর্তে ভ্যালেন্টাইন কারারক্ষীদের কাছে একটি কলম ও কাগজ চান। তিনি মেয়েটির কাছে একটি গোপন চিঠি লিখেন এবং শেষাংশে বিদায় সম্ভাষনে লেখা হয় ‘From your Valentine’ এটি ছিলো হৃদয়বিদারক। অতঃপর ১৪ ই ফেব্রুয়াররি, ২৭০ খৃঃ ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
রোমান ঐতিহ্য অনুসারে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে পালিত হত পৌত্তলিক রোমানদের উৎসব Lupercalia । ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ বা মধ্য ফেব্রুয়ারিতে পালিত হত এ উৎসব। নতুন জন্মের এ উৎসব নিবেদিত হত রোমান কৃষির দেবতা 'ফোনাস'র উদ্দেশ্যে । রোমান পূরোহিতদের বলা হত 'লুপারসি'। কথিত আছে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রেমুস এবং রোমুলাস কে পাহাড়ের গুহাতে লালনপালন করে নেকড়ে বাঘ 'লুপা' সেই পবিত্র গুহাতে লুপারসিরা মধ্য ফেব্রুয়ারিতে সমবেত হতেন। সেখানে নতুন জন্মের আশীর্বাদ চেয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে পাঠা বলি দেওয়া হত আর আত্মশুদ্ধির প্রতীক হিসেবে বলি দেওয়া হত কুকুর। পাঠার সে চামড়া রক্তে ভিজিয়ে তা দিয়ে যুবতীদের এবং শস্য ক্ষেত্রকে স্পর্শ করা হত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে এই স্পর্শ ভূমি এবং যুবতীদেরকে আরো ফলদায়ীনি করবে। বিকেলের দিকে কুমারী যুবতিদের নাম চিরকুটে লিখে একটি পাত্রে বা বাক্সে জমা করত। অতঃপর ঐ বাক্স হতে প্রত্যেক যুবক একটি করে চিরকুট তুলত, যার হাতে যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবৎসর ঐ মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত। আর তাকে চিঠি লিখত, এ বলে ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমার প্রতি এ পত্র প্রেরণ করছি।’ বৎসর শেষে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হতো। এ রীতিটি কয়েকজন পাদ্রীর গোচরীভূত হলে তারা একে সমূলে উৎপাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খৃষ্টান ধর্মায়ণ করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভ্যালেনটাইন’-এর নামে প্রেরণ করতে হবে। কারণ এটা খৃষ্টান নিদর্শন, যাতে এটা কালক্রমে খৃষ্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ৫ম শতাব্দীতে পোপ গেলাসিয়াস ১৪ ই ফেব্রুয়ারিকে 'সেন্ট ভ্যালন্টাইন দিবস' হিসেবে ঘোষনা করেন।
তবে এটি ভালবাসার দিন হিসেবে জনপ্রিয়তা পেতে সময় লেগেছে আরো অনেক বছর। মধ্যযুগে ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে বিশ্বাস ছিল যে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি থেকে সে দেশে পাখীদের প্রজনন শুরু। সে বিশ্বাস সাহায্য করেছে ১৪ই ফেব্রুয়ারিকে ভালবাসার দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে । ১৪ই ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইন দিনের সবচে পুরনো লেখা হল লন্ডনের বৃটিশ লাইব্রেরীতে রক্ষিত অর্লিয়ান্সের ডিউক, চার্লসের কবিতা। এজিনকোর্টের যুদ্ধে পরাজয়ের পর টাওয়ার অফ লন্ডনে বন্দী থাকা অবস্থায় ডিউক ১৪১৫ সালে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখেন সে কবিতা। এর কয়েক বছর পর ইংল্যান্ডের রাজা হেনরী-৫ প্রেমিকা ক্যাথরিন ভালোয়ার উদ্দেশ্যে ভ্যালেন্টাইন দিবসে কবিতা লেখান লেখক জন লিন্ডগেটকে দিয়ে। এছাড়াও ১৪'শ শতকের রোমান্টিক কবিদের ভূমিকাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
আমাদের দেশে ১৯৯৩ সালের পূর্বে এই দিবসের খুব একটা প্রচলন ছিল বলে ধারণা পাওয়া যায় না। এখনকার দিনের তরুণ-তরুণীরা এর ইতিহাস সম্পর্কে কতটা জানে সে বিষয়ে আমার ধারণা নেই তবে এই দিবসের ক্রমাগত বিবর্তন এবং ১ দিন থেকে ১ সপ্তাহে পরিণত হওয়া ইত্যাদি আসলে আমাদের জন্য কতটা ভাল নাকি খারাপ সে বিষয়ে এখনই আমাদের ভেবে দেখা দরকার।
0 comments:
Post a Comment